একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে, ইংরেজি কেবল একটি ভাষা নয়, এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভালো ইংরেজি জানার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং ব্যক্তিগত সাফল্যের জন্য ইংরেজি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
আমাদের চারপাশের কিছু বাস্তব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে ইংরেজি জানা আর না জানার পার্থক্যটা সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
প্রথম ঘটনা: রেজওয়ান বনাম ফারহানা – কর্মজীবনে যোগাযোগের প্রভাব
রেজওয়ান, একজন কম্পিউটার সায়েন্সের মেধাবী ছাত্র হলেও ইংরেজিতে তেমন দক্ষ ছিলেন না। স্নাতক হওয়ার পর দেশীয় কোম্পানিতে চাকরির আবেদন করলেও, বিদেশি ক্লায়েন্টের সাথে মিটিংয়ের সুযোগ এলে তার ইংরেজি দুর্বলতার কারণে তিনি পিছিয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তাকে এমন একটি চাকরিতে সন্তুষ্ট থাকতে হয় যেখানে ইংরেজি জানার প্রয়োজন ছিল না এবং বেতনও তুলনামূলকভাবে কম ছিল।
অন্যদিকে, তার সহপাঠী ফারহানা। তার একাডেমিক ফলাফল খুব একটা ভালো না হলেও তিনি ইংরেজিতে সাবলীল ছিলেন এবং তার লেখার হাতও ছিল চমৎকার। স্নাতকের পর তিনি খুব সহজেই একটি নামকরা বহুজাতিক সফটওয়্যার কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি পেয়ে যান, যেখানে তাকে নিয়মিত বিদেশি ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। এই ঘটনাটি স্পষ্ট করে যে, শুধু একাডেমিক ফলাফল নয়, যোগাযোগের দক্ষতা, বিশেষত ইংরেজিতে সাবলীলতা কর্মজীবনে কতটা প্রভাব ফেলে।
দ্বিতীয় ঘটনা: আফসানা ইয়াসমিন – হস্তশিল্পে আন্তর্জাতিক বাজার জয়
আফসানা ইয়াসমিন, একজন গৃহিণী। তিনি অনলাইনে হস্তশিল্পের ব্যবসা শুরু করে প্রাথমিকভাবে শুধু দেশীয় গ্রাহকদের কাছে পণ্য বিক্রি করতেন। কিন্তু যখন তিনি তার পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার তৈরির কথা ভাবলেন, তখন দেখলেন যে বিদেশি ক্রেতাদের সাথে কার্যকর যোগাযোগের জন্য তাকে ইংরেজিতে দক্ষ হতে হবে। তিনি একটি অনলাইন কোর্স করে ইংরেজি শিখলেন এবং এখন তিনি অনায়াসেই তার পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করছেন, যা তার ব্যবসাকে বহুগুণ বাড়িয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, উদ্যোক্তা জীবনেও ইংরেজি কীভাবে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
তৃতীয় ঘটনা: সালেহ আহমেদ – গবেষণায় সাফল্যের চাবিকাঠি
সালেহ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক। তার গবেষণার জন্য প্রচুর আন্তর্জাতিক জার্নাল এবং বই পড়তে হয়, যার বেশিরভাগই ইংরেজিতে। ভালো ইংরেজি জানার কারণে তিনি সহজেই এই গবেষণাগুলো বুঝতে পারেন এবং তার নিজের গবেষণা প্রবন্ধও আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রকাশ করতে সক্ষম হন। যদি তার ইংরেজিতে দুর্বলতা থাকত, তাহলে তার গবেষণার পরিধি অনেক সীমিত হয়ে যেত এবং আজকের এই সাফল্য এতো সহজে হয়তো ধরা দিতো না। এই উদাহরণটি দেখায় যে, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় ইংরেজির জ্ঞান কতটা মৌলিক।
ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য পেতে হলে বর্তমানে বাংলাদেশে ইংরেজির ওপর দক্ষতা অর্জন করা এখন শুধু সময়ের দাবি।
কর্মজীবনে ইংরেজির গুরুত্ব
বর্তমানে বাংলাদেশে চাকরির বাজারে ভালো ইংরেজি জানা প্রার্থীর কদর অনেক বেশি। বহুজাতিক সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে দেশীয় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত এমন কর্মী খুঁজছে যারা ইংরেজিতে সাবলীল। উদাহরণস্বরূপ, একজন ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট যদি ইংরেজিতে দক্ষ হন, তবে তিনি সহজেই বিপিও (বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং) শিল্পে ভালো বেতনের চাকরি পেতে পারেন। বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধনশীল এই খাতে ইংরেজির গুরুত্ব অপরিসীম। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও (যেমন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডেটা অ্যানালাইসিস) আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের সাথে কাজ করার জন্য ইংরেজি অপরিহার্য।
উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় অপরিহার্যতা
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত গবেষণা এবং উচ্চমানের শিক্ষাসামগ্রী ইংরেজিতেই প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যখন বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করেন, তখন তাদের আইইএলটিএস (IELTS) বা টোফেল (TOEFL)-এর মতো ইংরেজি দক্ষতা পরীক্ষার ফলাফলের প্রয়োজন হয়।
দেশের ভেতরেও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক রেফারেন্স বই ও জার্নাল ইংরেজিতে হওয়ায়, ভালো ইংরেজি জ্ঞান শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্সে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়নের ফলে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ বাড়ছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও সেবা প্রসারের জন্য ইংরেজি জানা অত্যাবশ্যক। একজন ব্যবসায়ী যখন আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সাথে ডিল করেন, তখন ভালো ইংরেজি তাকে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে এবং ব্যবসার সুযোগ তৈরি করতে সাহায্য করে। এমনকি পর্যটন শিল্পেও বিদেশি পর্যটকদের সাথে যোগাযোগের জন্য ইংরেজি জানা হোটেল, রিসোর্ট এবং ট্যুর অপারেটরদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডিজিটাল বিশ্বে ইংরেজির গুরুত্ব অপরিসীম। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে বেশিরভাগ তথ্য ও কনটেন্ট ইংরেজিতেই পাওয়া যায়। ফ্রিল্যান্সাররা আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে কাজ করার জন্য ভালো ইংরেজি ব্যবহার করে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেন এবং এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন। এটি দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
বর্তমান বাংলাদেশে ব্যক্তিগত, পেশাগত এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সাফল্যের জন্য ইংরেজি দক্ষতা অপরিহার্য। এটি এখন কেবল একটি ঐচ্ছিক যোগ্যতা নয়, বরং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার এবং বিশ্বায়নের যুগে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার একটি মৌলিক প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার দ্বার উন্মোচন থেকে শুরু করে পেশাজীবীদের জন্য উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তাদের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার প্রদানে ইংরেজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ডিজিটাল যুগে এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রসারেও ইংরেজির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই, দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির জন্য ইংরেজি শিক্ষাকে আরও গুরুত্ব দেওয়া এবং এর প্রসারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত আবশ্যক।
রেজিনা সুলতানা
বিভাগীয় প্রধান এবং চেয়ারম্যান
ইংরেজী বিভার
কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় অব বাংলাদেশ