
বিভিন্নসংবাদেপ্রকাশ, করোনাভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়া মানুষের মৃত্যুর পর কিছু অতিউৎসাহী এলাকাবাসী আক্রান্ত মানুষকে কবর দিতেও বাধা দিচ্ছে। আমাদের সমাজের ইতিহাসে এইধরনের আচরণ অত্যন্ত বিরলই নয়, আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শের সম্পূর্ন বিপরীত। এছাড়া আক্রান্ত হতে পারে এই ভয়ে করোনা চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মানেও বাধা দিচ্ছে এলাকাবাসী। আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন মানুষকে সামাজিক ভাবে বয়কট করা হচ্ছে।
এই ধরনের আচরণ অত্যন্ত অবিমৃষ্যকারী।
এখন আমরা একটু দেখি কেন এই আচরণ?
এই আচরণের নেপথ্যে আছে মানুষের এই রোগ সম্পর্কে ভূল ধারনা।
রোগটি অতি মাত্রায় সংক্রামক ও অত্যন্ত ছোঁয়াচে। এতে কোন সন্দেহ নেই। এতে করে মানুষের মাঝে ধারনা হয়েছে কোন এলাকায় একজন রোগী থাকলে বা এই রোগ চিকিৎসার হাসপাতাল থাকলে কিংবা কোন মৃতদেহ সৎকার করলে হয়তো সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু আসলেই কি তাই?
আসুন একটু জেনে নিই আসলেই রোগটা কিভাবে ছড়ায়:
এখন পর্যন্ত জানা বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিচারে করোনা ছড়ায় হাঁচি, কাশি বা রেসপিরেটরী ড্রপলেটের মাধ্যমে।
কিন্তু কিভাবে কারও শরীরে প্রবেশ করে?
এটি প্রবেশ করে ও শ্বাসপ্রশাসের মাধ্যমে অথবা এই জীবানু আছে এমন কিছু আপনার হাতে বা শরীরের কোন অংশে লেগে থাকলে এবং সেই অংশ আপনার চোখ, মুখ, নাক বা শরীরের কোন খোলা অংশে অপরিষ্কার অবস্থায় স্পর্শ করলে।
তাহলে এর থেকে বাঁচার উপায়?
বাঁচার উপায় হল দুটো।
এক, নিজের শরীরকে ভাইরাস আছে এমন কিছুর সংষ্পর্শে না আনা। এর জন্য করনীয় হল, স্যোসাল ডিসট্যান্সিং।
- স্যোসাল ডিসট্যান্সিং হল, পরষ্পর থেকে ১ মিটার বা ৩ ফুট দূরত্বে অবস্থান করা।
- যারা সংক্রমিত হতে পারেন বলে ধারনা করা যাচ্ছে বা সংক্রমিত মানুষের সংষ্পর্শে এসেছেন তাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা
- যারা আক্রান্ত হয়ে গেছেন তাদের আইসোলেশনে রাখা
কি লাভ এতে?
এতে লাভ হল আপনি যদি আক্রান্ত ব্যক্তির বা জীবানুবাহকে সংষ্পর্শে না যান তাহলে আপনি আক্রান্ত হবেন না আর আপনিও অন্য দের মাঝে ছড়াবেন না। ফলে আস্তে আস্তে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও কমে আসবে।

ভাইরাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমন বন্ধ করা গেলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর ভাইরাস নিজেই মারা যাবে বা কার্যকারিতা হারাবে।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে কিভাবে একজন সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে অনেক ব্যক্তিতে রোগ ছড়ায়।
একই সাথে মাত্র একজন মানুষ থেকে দূরে থেকেও কতজনের মাঝে রোগসংক্রমন রোধ করা যায়, পাশাপাশি একজনের সংষ্পর্শ থেকে কত জনের মাঝে রোগ ছড়াতে পারে তা এই ছবিতেই প্রমান পাওয়া যায়।
তাই-
সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ– স্যোসাল ডিসট্যান্সিং।
এতকিছুর পর ও যদি কেউ আক্রান্ত হয়ে যান, কি হবে তাহলে?
বিশ্বাস রাখুন।করোনা সংক্রমণ মানেই নিশ্চিত মৃত্যু নয়।
চলুন একটু চোখ বুলিয়ে নিই বিশ্বের সমস্ত করোনা রোগীর তথ্যের দিকে।
যারা আক্রান্ত হবেন তাদের পরিনতি তাহলে কি?
বিখ্যাত পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান WORLDOMETER এর তথ্যমতে, যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের শতকরা ৯৫ জনই স্বল্পমাত্রার জটিলতায় ভুগছেন এবং তাদের সুস্থ্য হয়ে যাওয়ার হার অনেক বেশি।
অন্যদিকেশতকরা ৫ জন গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, গুরুতর আক্রান্ত যারা হচ্ছেন তাদের অধিকাংশেরই অন্য গুরুতর অসুখ ছিল ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল দূর্বল।

এতে দেখা যাচ্ছে, অতিসংক্রামক হওয়ার কারনে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা রাখা প্রয়োজন যাতে রোগটা না ছড়ায় সেদিকে। তাছাড়া চিকিৎসায় সুস্থ্যতার হার যথেষ্ঠ হওয়ায় উপযুক্ত চিকিৎসা ও আইসোলেশনের মাধ্যমে সহজেই রোগমুক্তিও সম্ভব।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে অধিক বয়ষ্ক ব্যক্তিদের মাঝেই মৃত্যু হার বেশি।
বয়স ভিত্তিক মৃত্যু হার নিন্মরুপ-

সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া সত্ত্বেও আক্রান্ত হয়েছেন যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও যুবরাজ। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী আক্রান্ত হয়েছিলেন আবার ইতোমধ্যে সুস্থ্য হয়েও গেছেন।
অতএব আপনি আমি আক্রান্ত হবনা এই নিশ্চয়তা কি দেওয়া সম্ভব?
তবে স্যোসাল ডিসট্যান্সিং পারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কে শুন্যের কাছাকাছিতে নিয়ে আসার আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহন করুন।
জানি কঠিন, তবুও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করুন।
পৃথিবীর এই ভয়ঙ্করতম দুঃসময়ে কেউ কাউকে দোষারোপ নয়, হিংসা নয়, অহংকার নয়– আসুন আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায় হোক করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় আমাদের সম্মিলিত যুদ্ধ।
বিশ্বাস করুন, একা বাঁচা সম্ভব নয়, সকলের একত্রিত পদক্ষেপেই কেবল সম্ভব এই যুদ্ধে মানুষের জয়।
জয় হোক মানুষের

এমফিল রিসার্চ ফেলো- পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফর্মেটিক্স
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেসনালস
ডা. অনুপম দাস, বর্তমানে জনস্বাস্থ্য চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। এমবিবিএস সম্পন্ন করে জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি প্রকল্পে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীতে ব্র্যাকের মাধ্যমে কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের কেস কন্ট্রোল ট্রায়ালে কো-ইনভেস্টিগেটর হিসেবে কাজ করেছেন।
বর্তমানে সেন্টার ফর নন কমিউনিকেবল ডিজিজ এন্ড নিউট্রিশনের অসংক্রামক ব্যধি সার্ভিলেন্স কাজে যুক্ত এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেসনালস এ জনস্বাস্থ্য বিষয়ে এমফিল গবেষণারত।